ছিটমহল বিলুপ্ত হওয়ার আগে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতীয় নাগরিক হওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়ে ওরা হয়েছিলেন ভারতীয় নাগরিক। এখন ভারতে না গিয়ে বাংলাদেশেই থেকে যেতে চান বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার ৫৫ অধিবাসী।
রোববার ১১ অক্টোবর দাশিয়ারছড়ার ১৩ পরিবারের এসব মানুষ কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বরাবর এ বিষয়ে লিখিত আবেদন করেছেন।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন বলেন, “১৩টি পরিবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে থেকে যেতে চান। তবে এটি এখন দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।”
সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকারী নারায়ণ বর্মণের পরিবারের সদস্য চারজন, রামপ্রসাদ বর্মণের চার, বাবুল বর্মণের চার, শশীভূষণ বর্মণের তিন, গজেন্দ্র বর্মণের ছয়, কৃষ্ণকান্ত বর্মণের পাঁচ, মণীন্দ্র বর্মণে চার, মোহন বর্মণের তিন, মিলন বর্মণের পাঁচ, দধিরাম বর্মণের পাঁচ, কামনী বর্মণের চার, আব্দুল্লাহ রহমানের পাঁচ এবং বদিয়ার রহমানের পরিবারের সদস্য তিনজন।
ভারতে যেতে না চাওয়ার কারণ সম্পর্কে বাবুল চন্দ্র বর্মণ (৪০) বলেন, “গত মাসে ট্রাভেল পাস পেয়ে ৩৯ জন একসাথে ভারতে বেড়াতে গিয়ে দেখি, দিনহাটার কৃষিমেলার পাশে আবাসন গড়া হচ্ছে আমাদের জন্য। ১২ ফুট বাই ১৪ ফুট করে একটি ঘর পরিবার প্রতি বরাদ্দ দেওয়া হবে। ঘিঞ্জি পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে। কাজকর্মের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোচবিহার জেলার ডিএমের সাথে দেখা করি। তিনি জানান, জমিজমা বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে ভারত সরকারের এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেই।”
লিটন চন্দ্র নামের আরেকজন বলেন, “আগে শুনেছিলাম, ভারত সরকার প্রত্যেক পরিবারকে একটি করে ফ্ল্যাটবাড়ি দেবে, দুই বছরের শুকনো খাবার, গবাদিপশুর খাবারসহ সর্বপ্রকার খাবার দেবে। এছাড়া পরিবার প্রতি এককালীন পাঁচ লাখ করে টাকা দেবে, ইত্যাদি। বাস্তবে এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই।”
দাশিয়ারছড়ার একটি প্রতিনিধি দল ভারতের ট্রাভেল পাস ফেরত দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে ভারতীয় হাই কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন জেলা প্রশাসকের কাছে। কৃষ্ণকান্ত বর্মণ (৬৫) বলেন, “হামরা লোভত পড়ছিলং। অ্যালা ভারত যাবার চাই না। এ মাটি ছাড়ি যাবার নই। তোমরা বাহে নেকি দেও, দয়ার সাগর শেখ হাসিনা হামাক যাতে বাংলাত থাইকপার দেয়।”
অশীতিপর দধিরাম বর্মণের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, “বাপ-দাদার ভিটা এটা। জন্ম হইছে এই মাটিত, অ্যাটায় যাতে মৃত্যু হয়। এই মাটি ছাড়ি যাবার নই,” বলেন তিনি।
শ্রীমতী দেবযানীর (৭০) এক চোখ অন্ধ। অন্য চোখেও ভালো দেখেন না। তার সাফ কথা, “অ্যাটি জন্মিছি, অ্যাটি মরমো। হামরা ভারত যাবার নই। ওমরাগুলা জোর করি ভারত যাবার জন্য নাম নেকাইছে। অ্যালা বুঝছি ক্ষতি হইছে।”
পরিবারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে খুশি সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুবর্ণা। সে বলে, “বন্ধুদের ছেড়ে যেতে মন চায় না। বাংলাদেশকে খুব ভালো লাগে। পরিবারের ইচ্ছায় ভারতে যাবার জন্য নিবন্ধন করি। এখন পরিবারের সবার মত পাল্টে গেছে। সবাই এ দেশে থাকতে চাই। এই খবর শুনে আমার খুব ভালো লাগছে। দুর্গাপূজায় ভগবানের কাছে আমার একটাই চাওয়া, আর তা হল বাংলাদেশের নাগরিকত্ব,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশের ভিতরের মোট ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে ভারত যেতে নিবন্ধন করেন ৯৭৯ জন। অপরদিকে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলের প্রায় ১৪ হাজার মানুষের কেউ বাংলাদেশে আসতে আগ্রহ দেখাননি।
সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর ১২টি কুড়িগ্রাম জেলায়। এখানকার ৩১৭ জন ভারতে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।