আরমান হোসেন টুটুল: সরকারি চাকরিজীবীদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) নির্দিষ্ট সময়ে জমা দেয়ার বিষয়ে আগ্রহ না থাকায় পরিপত্র জারি করেও সাড়া পায়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এ কারণে প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন কর্মকর্তাকে দেয়া হয় কারণ দর্শানো নোটিশ। ফলে এ জটিলতা নিরসনে বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন (এনুয়াল পারফরমেন্স এপ্রাইজাল রিপোর্ট) এপিএআর প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নির্ধারিত সময়ে এসিআর জমা না দিলে বিভাগীয় শাস্তিসহ একাধিকবার জারি করা হয় বিভিন্ন নির্দেশনা। কিন্তু কাজে আসে না। দেখা দেয় নানা প্রশাসনিক জটিলতা। প্রশাসনিক কাজে প্রত্যাশিত গতি না আসায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের এসিআর এর পরিবর্তে কর্মভিত্তিক মূল্যায়ন (পারফরমেন্স বেইজড ইভ্যালুয়েশন সিস্টেম) এর আওতায় বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন এপিএআর প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে দেশে সরকারি-কর্মকর্তা কর্মচারির সংখ্যা ১৪ প্রায় লাখ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানাগেছে, এপিএআর প্রতিবেদনকে আট ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর প্রথম অংশে প্রতিবেদনাধীন কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত বিষয়ের তথ্য প্রদান করবেন। ২য় অংশে বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনায় সম্পাদনযোগ্য কাজের সংখ্যা পারস্পারিক সম্মতির ভিত্তিতে সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় অংশে গোপনীয়তার সঙ্গে প্রতিবেদনাধীন কর্মকর্তার কর্মকৃতির মূল্যায়ন, ব্যাক্তিগত বৈশিষ্ট ও পেশাগত দক্ষতা মূল্যায়ন করে চূড়ান্ত সর্বমোট নম্বর প্রদান করবেন।
চতুর্থ অংশে যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতা/প্রবণতা ও সুপারিশকৃত প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এতে কর্মকর্তার বিশেষ যোগ্যতা/অধিক যোগ্যতার জন্য ১, অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতা বোঝাতে ক্রমান্বয়ে ২,৩,৪ নম্বর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অংশটি নিয়ন্ত্রকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তরের পদায়ন শাখা মূল্যায়ন করবে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, আইন ও বিধির জ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সাংগঠনিক যোগ্যতা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান, শিক্ষামূলক কর্মকা-, দূর্যোগ বা সংকট মোকাবেলা ও বাগ্মীতার বিষয়ে নম্বর দিবে সংশ্লিষ্ট শাখা।
জরুরী প্রশিক্ষণের বিষয়ে ১ এবং কম জরুরী ক্ষেত্রে ক্রমান্নয়ে ২,৩,৪ নম্বর দিবে নিয়ন্ত্রকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তরের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত শাখা।
ক্যাডারভিত্তিক প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, আদালত ব্যবস্থাপনা, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট, স্থানীয় সরকার বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ভাষাগত দক্ষতা, কর্মমূল্যায়ন প্রশিক্ষণ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, অফিস ব্যবস্থাপনাসহ সিনিয়র ষ্টাফ কোর্স বিষয়ে নম্বর দেয়া হবে।
৫ম অংশে কর্মকর্তা সম্পর্কে সার্বিক মন্তব্যসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হলে প্রতিবেদনকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করবেন। আরও বলা হয়েছে, প্রতিবেদনাধীন কর্মকর্তাকে এর আগে কোনো বিষয়ে সতর্ক করা হয়ে থাকলে তার স্বারক নম্বর ও তারিখ উল্লেখ করতে হবে।
৬ষ্ঠ অংশে প্রতিবেদনকারী কর্মকর্তা প্রদত্ত নম্বরের সঙ্গে একমত বা ভিন্নমত থাকলে তা জানাবেন প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা। তাছাড়া কর্মকর্তার করা বিরুপ মন্তব্যের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কিনা তাও জানাবেন তিনি। এতে সার্বিক মন্তব্যও থাকবে।
৭ম অংশে ফরম পূরণ ও স্বাক্ষরের তারিখ, বিলম্বের কারণ, যে পত্রে চুড়ান্ত নম্বর জানানো হয়েছে তার স্বারক নম্বর ও তারিখ, প্রাপ্ত নম্বরের বিষয়ে আপীল হয়েছে কিনা এবং আপীল হলে তার আদেশ পত্র নম্বর ও তারিখ, আপীল কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত নম্বরসহ কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর যদি কোনো কার্যক্রম থাকে সেটা জানাতে বলা হয়েছে। আপীল নিষ্পত্তিকারী কর্মকর্তার নাম, পরিচিতি নম্বর, সীল-স্বাক্ষর ও তারিখ জানাতে হবে।
৮ম অংশে কর্মসম্পাদনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাকে।
সংশ্লিষ্ট যোগ্যতার ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে স্থান-কাল পাত্র ভেদে ভাষা/শব্দের যথাযথ প্রয়োগে পারদর্শী, সহকর্মীদের অনুপ্রানিত/উৎসাহিত করা ও নেতৃত্ব দানে উদাহরণ সৃষ্টি করা, ভাষার দক্ষতা, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আন্তরিক, যৌক্তিক, ন্যায্য, সৌজন্যমূলক আচরণ, দৃশ্যমান আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জীবন-যাপন, সরকারি অর্থ ব্যয়ে মিতব্যয়ি এবং সকল পর্যায়ে সহকর্মী ও নাগরিকের সঙ্গে বিনয়ী, ভদ্র, অন্যের মতামতকে ইতিবাচকভাবে দেখলে ১০ থেকে ৯ নম্বর।
ভাষার যথাযথ প্রয়োগ, সহকর্মীদের পরিচালনায় দায়িত্ববান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আন্তরিক, যৌক্তিক, ন্যায্য, সৌজন্যমূলক আচরণ, বিনয়ী-ভদ্রতার পাশাপাশি অন্যের মতামতকে ইতিবাচকভাবে দেখার জন্য ৮ থেকে ৭ নম্বর।
তাছাড়া ভাষা প্রয়োগে অদক্ষ, নেতৃত্বদানে ঔদাসিন্য ও মানসিকতার ঘাটতি, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে অসঙ্গত আচরণ, সৌজন্যবোধের অভাব, আয়ের সঙ্গে জীবন-যাপনের অসঙ্গগতি, ব্যয়ের ক্ষেত্রে অমিতব্যয়ী, অন্যান্য মতামতকে অবজ্ঞা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ৬ থেকে ৪ নম্বর দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
পেশাগত বৈশিষ্টের ক্ষেত্রে আইন/বিধি-বিধান ও পদ্ধতির জ্ঞানসহ তার সফল প্রয়োগ, উদ্যোগ গ্রহনে সক্ষমতা, আইন-বিধি ও বাস্তবতার আলোকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতনকে অবহিত করণ, লক্ষ্য ও সময় মত কর্ম সংগঠনে দলগত প্রচেষ্টায় সক্ষমতা, উদ্দেশ্য ও বাস্তবস্থা বিবেচনায় তদারকি/পরিচালনায় সক্ষমতা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা, অধীনদের প্রশিক্ষণ/দক্ষতা উন্নয়নে স্বত:স্ফুর্ত তৎপর, অধীনদের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও মূল্যায়নে দক্ষতা. দপ্তরের সার্বিক ভৌত ও তথ্যের নিরাপত্তায় সচেতন, দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক প্রকাশে ১০ থেকে ৯ নম্বর।
একই বিষয়ে আইন/বিধিবিধান ও পদ্ধতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রচেষ্টা রয়েছে, ঊর্ধ্বতনের নির্দেশের অপেক্ষা ও দ্বায়িত্ব সম্পাদনে সাধারণ উদ্যোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম, কর্ম-সংগঠনে সক্ষম, কর্ম তদারকি/পরিচালনায় সক্ষম, অধিকাংশ সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ, সহকর্মীদের পেষাগত দক্ষতা উন্নয়নে তৎপর, বার্ষিক কর্মমূল্যায়নে নিরপেক্ষ, পেশাদারিত্ব বিবেচনায় দক্ষতা প্রদান, অফিস/তথ্যের নিরাপত্তায় সাধারণভাবে সচেতন ও সহকর্মী/নাগরিকদের সঙ্গে বিনয়ী, ভদ্র ও অন্যের মতামতকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার জন্য ৮ থেকে ৭ নম্বর।
আইন, বিধিবিধান সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান ও মনোযোগ কাঙ্খিত মাত্রায় না থাকা, কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা/তৎপরতার অভাব, দলগত প্রচেষ্টা গ্রহণের অভাব, তদারকি ও পরিচালনায় অক্ষমতা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় সীমিত দক্ষতা, সহকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগের অভাব, সহকর্মীদের কর্মমূল্যায়নে নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও বিবেচনায় অদক্ষ, তথ্যের নিরাপত্তায় তৎপর নন এবং মনোযোগের অভাব, আরণের ক্ষেত্রে বিনয় ও ভদ্রতার ঘাটতিসহ অন্যান্য মতামতের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনের কারণে ৬ থেকে ৪ নম্বর দেয়ার কথা বলা হয়েছে এপিএআরে।
একজন অতিরিক্ত সচিব নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, এসিআর এর পরিবর্তে এপিএআর উদ্যোগ কর্মকর্তাদের জন্য ভালো হবে। এটি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।