ভালোবাসার গল্প 2
- আপডেট সময় : ০৯:৫৮:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৪ ১১ বার পড়া হয়েছে
“ইয়ানা আপি,,,, রিফাত দাভাই চলে এসেছে।”
কথাটি কর্ণ ঘাত হতেই এই নভেম্বর মাসের হালকা ঠান্ডার মধ্যেও শরীরে পুলক লাগে ইয়ানার
রক্ত হিম হয়ে গেলো,চারটা বছর পর আবার তার দেখা মিলবে কথাটি ভাবতেই জোরে হাত চেপে ধরে রেলিং এ।। বুকের ভেতর হওয়া উথাল পাথাল ঢেউ খেলানো অনুভুতির সাগরে ডুবে যাচ্ছে সে।শরীরে কেমন অবশ ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।। ঘনো প্রশ্বাস ছেড়ে আকাশের পানে চেয়ে রইল,,,অর্ধ চাঁদের ও এত জোৎস্না হয়? আচ্ছা তারা গুলি এরকম মিট মিট করে জ্বলে কেনো? মেঘ কেনো ছুঁয়ে দেখা যায় না?নিজের মনে জাগ্রত হওয়া এই উদ্ভট প্রশ্নের জবাবে শুধুমাত্র ঠোঁট বাঁকাল ইয়ানা।। যবে থেকে শুনেছে রিফাত ইন্ডিয়া ব্যাক করেছে,তবে থেকেই ইয়ানা এমন উদ্ভট কল্পনার শিকার হয়েছে।। আর আজ তো সেই কঙ্কিত মানুষটা চলে ও এসেছে। একই বাড়ি তে সে কতদিন নিজেকে সরিয়ে রাখবে,পালিয়ে বেরাবে?
নিজেকে ঠিক রাখতে চোখে মুখে হালকা হাত বুলিয়ে গায়ে জড়ানো পাতলা চাদরটা সামান্য একটু টেনে নিল।। ইয়ানার এই অস্বাভাবিক ভাবে বুকের ধুক পুকুনি কেও শুনতে পেলো না,,,শুধুই তার এই অবস্থার সাক্ষী হয়ে রইলো আকাশের সেই অর্ধ চন্দ্র।।
হঠাৎ গলা কেমন শুখিয়ে আসছে,,,কিছুক্ষন আগেই পানিতে ভিজিয়ে রাখা গলা শুকিয়ে আসাতে বিরক্ত হলো ইয়ানা।। ব্যালকনি ত্যাগ করলো না বরং হালকা জোর আওয়াজে বললো,,,
“আলু,,, বিছানার পাশের টেবিল থেকে পানির বোতল টা নিয়ে আয় তো।”
ইয়ানার আওয়াজ কানে আসতেই আলু নামে সম্মধন করা মেয়েটা চমকে উঠলো কারণ সে এতক্ষণ তার ইয়ানা আপির গতিবিধি লক্ষ্য করতে ব্যাস্ত ছিলো।। কেনো জানি সদ্য ষোলো বছরে পদার্পণ করা মেয়েটার মনে হচ্ছে তার ইয়ানা আপি রিফাত দাভাই এর নাম শোনার পর থেকেই কেমন আজব আচরণ করছে।।টেবিলের ওপর থেকে বোতল নিয়ে তার ইয়ানা আপির পাশে দাঁড়ালো।।পানির বোতল নিয়ে ইয়ানা পাশে রাখা চিয়ারে বসে প্রথমে তিন ঢোকে তারপর এক নিশ্বাসে হাফ বোতল পানি সাপাট করে ফেললো।।
এরই মধ্যে ইয়ানা শুনতে পেলে তার পাশে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির অভিমানী কণ্ঠ,,,,”আমার নাম আলেয়া আপি, আমি কত বার তোমায় বলেছি আমাকে আলু বলে ডাকবে না,,,সবাই মজা করে তো।”
ইয়ানা হাসে।হাসলে এক গালে টোল পড়ে মেয়েটার।।আলেয়ার হাত ধরে সামনে দার করায়,,,মেয়েটার লম্বা সিল্কি চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,,”আলুতে কি খারাপ?সমস্ত সবজির সাথে নিজেকে কেমন মিশিয়ে নেয়,,জানিস না?তেমন তুইও,,সব মানুষের সাথে খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে মিশিয়ে নিতে পারিস।”
আলেয়া ঠোঁট উল্টে বললো,,”ধুর এটাও কোনো লজিক হলো?!”
ইয়ানা ও ঠোঁট বাঁকিয়ে,ভ্রু নাচিয়ে বলল,,,”জানিনা,,,কিন্তু তুই হাজার বললেও আমি তোকে আলু বলেই ডাকবো।। তোর বাচ্চা কাচ্চা দের সামনেও।”
“ধুর আপি আমি তোমায় ডাকতে এসেছিলাম সেটা তো ভুলেই গেছি।চলো চলো নিচে,,, রিফাত ভাই সেই কখন এসেছে,,,দাদু বলেছে তোমায় যেনো সঙ্গে করে নিয়ে আসি।”
ইয়ানা বুকের মধ্যে ধক করে উঠল।। সে কিছুতেই নিচে যাবে না।নিচে গেলে সে ১০০% অজ্ঞান হয়ে যাবে।তাই কোনো ভাবেই নিচে যাওয়া যাবে না।কিন্তু আলেয়া নাছোড় বান্দা,,,দাদুর কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সর্বদা।।ইয়ানা হঠাৎ নিজের পেট চেপে ধরলো।যথা সম্ভব নিজের হলদেটে ফর্সা মুখশ্রীতে ব্যাথার্থ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললো,,,
“আলু,,,আমার ভীষণ পেটে ব্যাথা করছে,,,আমি এখন নিচে যেতে পারবো না।বিশ্রামের দরকার আমার।”
বলেই দ্রুত গতিতে হেঁটে বিছানার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো ইয়ানা।এদিকে হা করে তাকিয়ে আছে আলেয়া।এতক্ষণ তো তার আপি ঠিক ছিল হঠাৎ পেটে ব্যাথা হলো কি করে?কিন্তু ওই আলেয়া তো নাছোড় বান্দা।রুমে গিয়ে ইয়ানার হাত টেনে ধরে বলতে লাগলো,,,,
“চলো না আপি,,,তুমি না গেলে দাদু আমায় বকবে,,,প্লিজ চলো।।”
ইয়ানা চাদর হালকা সরিয়ে মুখ বের করে বললো,,,”আলু,,,আমার কিডনি তে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমার রেস্ট এর দরকার।”
এরকম অদ্ভুত রোগের কথা শুনে আলেয়া ইয়ানা র হাত দ্রুত ছেড়ে দেয়।। অপির এরকম অসুস্থতার কথা ভেবে আলেয়া হাল ছেড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।।
এদিকে ইয়ানা হাফ ছেড়ে বাঁচলো।।চাদর ছেড়ে উঠে দরজা লক করে দিলো সে।আজ সে বাইরে যাবে না কোনো পক্ষে।রাতে না খেয়ে থাকবে তাও ভালো কিন্তু নিচে নামবে না।।আবার নিজের শরীর বিছানায় বিছিয়ে দিল।চোখ বন্ধ করতেই কিছু পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠলো চোখের সামনে।।সেই দিন,,যেদিন রিফাত ভাই এর সাথে সে বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্ককে লিপ্ত হয়েছিলো।।শরীর কেপে উঠলো মুহুর্তেই।চোখ খুলে বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলো।।বুকের মধ্যে যেনো কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে।চোখে নোনা জল জমাট বেঁধেছে।বিধাতার এই বিধানের মুখোমুখি হবে সে কি ভাবে? কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ খিচে বন্ধ করতেই গড়িয়ে পড়ল সেই কলঙ্কিত বারিবিন্দু।।
আচ্ছা মানুষটা তাকে দেখে কেমন ব্যাবহার করবে? চার বছরে নিশ্চই অনেক বদলে গেছে! সেই গম্ভীর ভাব এখনো কি বিদ্যমান! কেমন দেখতে হয়েছে? আগে যেমন সুন্দর ছিল তেমনি আছে, নাকি বিদেশের হওয়া বাতাস ওনাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে?? এরকম হাজারো ভাবনা চিন্তা করতে করতে উঠে এসে আবার বারান্দায় দাড়ালো।।মন খারাপের সময় ইয়ানার প্রিয় জায়গা এই ব্যালকনি নাহলে ছাদ।।এখন বাহিরে যাওয়া যাবে না তাই ব্যালকনি দিয়েই কাজ চালাতে হবে।।
☞আলেয়া কে একা হেলে দুলে নিচে নামতে দেখে ইব্রাহিম সাহেব ভরাট কন্ঠে বলল,,,”এই হালিমা তোকে না বললাম ইয়ানা কে সাথে করে আনতে।”
আলেয়া চোখ মুখ বাঁকিয়ে সিড়িতে ধপ ধপ করে পা ফেলে নামতে নামতে বললো,,,”দাদু ওটা হালিমা না আলেয়া,,,আমার নাম টা তে কি বোমা ফিট করা যে,ঠিক ঠিক ভাবে উচ্চারণ করলে ফেটে যাবে।”
“ওই একই,,,মর্জিনা,,,,ইয়ানা কোথায়?”
আলেয়া আবার ও বিরক্তির নিশ্বাস ফেললো,,,সে জানে হাজার বললেও দাদু তার নাম উল্টা পাল্টা ডাকবে,,,তাই নিজের বুকের ফু দিয়ে বললো,,,,
“আপির নাকি কিডনিতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে,,,তাই শুয়ে আছে,,,বললো তাকে ডিস্টার্ব করতে না।”
সবে মাত্র রিফাত তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে ডাইনিং টেবিলের চিয়ার এর উপর এলিয়ে দিয়ে।গ্লাস থেকে পানি মুখে দিয়েছিল ঠিক তখনই আলেয়ার কথা শুনে বেসম্ খেয়ে কাশতে আরম্ভ করলো।।বিলেত ফেরত ডক্টর সে,,,হার্ট সার্জন।।কিন্তু সে নিজের মেডিকেল স্টুডেন্ট থেকে আর প্রতিষ্ঠিত ডক্টর হয়ে ওঠার এই লং জার্নির মধ্যেও ওরকম বিচ্ছিরি রোগের নাম শুনিনি। ফর্সা মুখখান মুহূর্তেই লাল হয়ে গেছে রিফাত এর,,,গোল ফ্রেমের চশমা টা টেবিলে খুলে রাখলো,,,।
রিফাত এর কাশির শব্দে রান্নাঘর থেকে ছুটে এল মিসেস আসফিয়া সাথে,, মেয়ের অদ্ভুত অসুস্থতার কথা শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসে ইয়াসমিন বেগম।। মিসেস আসফিয়া ছুটে আসলে ও রিফাত এর কাছে গেলেন না,,পা দুটো স্থির জমিয়ে রাখলেন রিফাত এর নিকট হইতে দুই পা দূরে,,,মন চাইছে ছুটে গিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে,,কপালে আদর পরশ দিয়ে জিজ্ঞাসা করতে “তুই ঠিক আছিস তো ?”,,,কিন্তু তিনি অসহায়,,,এই সুপ্ত ইচ্ছা দমিয়ে রাখলেন নিজের বুকের শেষ সীমানায়।,,শুধু করুন চোখে এক বার তাকালো তার স্বামীর দিকে,যে দূরে দাড়িয়ে সূক্ষ্ম ভাবে আসফিয়া কেই পরখ করে চলেছে,,হয়তো বুঝতে পেরেছেন তিনি সেই করুন দৃষ্টির আড়ালে থাকা ক্লেশ।।
এদিকে নাতির কাশির শব্দ শুনে ইব্রাহিম সাহেব সোফা থেকে উঠে রিফাত এর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,,
“দাদুভাই তুমি ঠিক আছো তো,,,এরকম হঠাৎ কেশে উঠলে কেনো?”
দাদুর কণ্ঠ আর স্পর্শ পেয়ে রিফাত এর কাশি থেমে যায় ক্ষণেই।। থমথমে মুখে গম্ভীর আওয়াজে বলে,,,”আমি ঠিক আছি।। টায়ার্ড লাগছে,,আমি রুমে যাচ্ছি। আমার খাবার রুমে পাঠিয়ে দিও।”
বলেই চশমা পরে, চিয়ার ছেড়ে লাগেজ নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।।,,,ইব্রাহিম সাহেব হতাশার নিশ্বাস ফেললো,,,নাতির অভিমান সম্পর্কে সে ভালই অবগত।।,,,চার বছর আগে নেওয়া তার সিদ্ধান্তের জন্য তার উপর এখনও নারাজ তার নাতি।।,,,কি করে সব ঠিক হবে??
মী.আফতাব (রাফাজ আর আলেয়ার বাবা) এগিয়ে এসে ইব্রাহিম সাহেব এর কাধে হাত রেখে নম্র কন্ঠে বলে,,,”আব্বু,,,অনেক রাত হয়েছে তোমার আর জেগে থাকা উচিত নয়।।,,, রিফাত বিশ্রাম নিক,কাল কথা বোলো তার সাথে।। চলো আমি তোমাকে রুমে পৌঁছে দিচ্ছি।”
ছেলের কথায় সম্মতি জানিয়ে মী.আফতাব এর হাত ধরে রুমে চলে গেল।।,,বিছানায় বসে ইব্রাহিম সাহেব মি.আফতাব এর দিকে তাকিয়ে বললো,,,
“দাদুভাই কি এখনও পর্যন্ত সব মেনে নিতে পারেনি?”
“হয়তো না আব্বু।।,,,আমার তো চিন্তা হয় মেয়েটাকে নিয়ে।।,,,ছেলেটা বড়ই জেদী,,,তার সম্মতি ছাড়া তার উপর চাপানো কোনো সিদ্ধান্ত সে কখনোই মেনে নেয়নি ।।দেখনা ,,,২১ বছরেও আসফিয়া কে সে এখনও পর্যন্ত ‘ মা ‘ বলে মেনেনিতে পারলো না।।” (এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)
ইব্রাহিম সাহেব ছেলের কথায় তার মনে মিশে থাকা ছেলের জন্য আক্ষেপ ভালই বুঝতে পারে।।সত্যি তার নাতি সত্যি যে বড়ই জেদী, রাগচটা,বদমেজাজি।কিন্তু এই সব কিছুর পরে ভীষণ শান্ত,,,কথা বলে মেপে,,,হাসে কম।।,,নাতির জন্য চিন্তার শেষ নেই তার।।এখন ইব্রাহিম সাহেব এর মনে একটাই কথা চলছে,,নাতির মনে কি ভাবে ভালোবাসার ফুল ফোটানো যায়।।
এদিকে ইয়াসমিন বেগম মেয়ের রুমের দরজার বেশ কয়েকবার কড়া নাড়লে ভিতর থেকে হালকা আওয়াজ আসে,,”ঘুমাই মাম্মা।। খাবো না।” মেয়ের গলার স্বর শুনে এক সস্থির নিশ্বাস ফেলে ইয়াসমিন বেগম চলে যায়।,,যাক তার মেয়ে ভালো আছে।।
☞রিফাত রুমে প্রবেশ করে,,,চারিদিকে তাকিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো পুরো রুমটা।।চার বছরে ও বদলায়নি কিছুই।সব আগেই মতই আছে।।সাজানো,গোছানো তার রুম,,,যেমন টা রিফাত রেখে গিয়েছিল।।রিফাত এগিয়ে গিয়ে তার বড়ো ব্যালকনির থাই গ্লাস খুলে ফেলতেই রুমে প্রবেশ করলো মাতাল হাওয়া,,যা ছুয়ে দিলো রিফাত এর সিল্কি চুল। কপালের উপর পড়ে যাওয়া চুল হাত দিয়ে পিছন দিকে ঠেলে দিলো সে।।
চার বছর পর দেশে ফিরেও কোনো রকম এর উৎফুল্লতা কাজ করছে না রিফাত এর মাঝে ।।আপন মানুষদের কাছে পেয়েও আনন্দ, সুখ অনুভব হচ্ছে না তার।। হয়তো সেই চার বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে,,,সব কিছুই কেমন অসহ্য লাগছে।।,,
সুঠাম দেহে জড়ানো লেদার জ্যাকেট টা খুলে বিছানায় রাখলো। লাগেজ থেকে কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে চলে গেলো ।কিছুক্ষণের মধ্যেই তাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সোজা ব্যালকনি তে চলে এলো রিফাত।তার ফ্রেশ হাওয়ার প্রয়োজন এখন ।। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে লম্বা একটা শাস টানলো সে।।তত্পর হঠাৎ করেই তার পাশের ব্যালকনির দিকে চোখ পড়তেই না চাইতেও চোখ জোড়া আটকিয়ে গেলো তার,,,,,,